সবুজ_ডায়েরীর_আত্মকথা পর্ব০৩

ডায়রীটা খুলছি আর ভাবছি, “আসলেই কি লোকটা হাবাগোবা, নাকি ভেতরে বুদ্ধির বাসা”। পড়া শুরু করলাম ডায়েরীর প্রথম পাতা থেকে,
—সেদিন বিয়ের রাতে যখন সে আমার কাঁধে মাথা রেখে ঢাকায় চলে আসছিলো, তখন নিজেকে প্রেমিক প্রেমিক লাগছিলো। ভার্সিটি জীবনে বাসের মধ্যে কোনো মেয়েকে কোনো ছেলের কাঁধে মাথা রাখতে দেখলে খুব হিংসে হতো। ইচ্ছে হতো, একটা প্রেম করতে। কিন্তু নিজের কাঁধটাকে বিয়ের আগ পর্যন্ত আমি পবিত্র রাখতে পেরেছি। আজকের দিনে এই কাঁধ তার মাথার স্পর্শ পাওয়ায় মনের মাঝে একধরনের ভালোলাগার প্রশান্তি বয়ে যাচ্ছিল।
—আমার একটা মারাত্মক মানসিক সমস্যা আছে, তা হলো সন্দেহ রোগ। আমার চোখে সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম সব বিষয় ধরা পড়ে, আর অযথাই এইসব বিষয়ে মনের মাঝে সন্দেহ সৃষ্টি হয়। বিয়ের পর থেকেই তার ছোট ছোট সব কাজ আমার মনে সন্দেহের তৈরি করতো। আমি বুঝতাম এটা আমার মানসিক সমস্যা। তাই আল্লাহর কাছে এর থেকে মুক্তির জন্য দুআ করতাম। এখন যত দিন যাচ্ছে ওর ভালোবাসা আর আবেগে আমার সন্দেহ করার প্রবণতা ততো কমে আসছে। এখন আর আগের মতো মনের মাঝে সন্দেহ জাগে না।
—মেয়েটা একটু বেশিই উদার। বিয়ের পর থেকে ওকে জামা কাপড় তেমন কিছু কিনে দিতে পারি নি। ঐদিন সাহায্যের জন্য এক মেয়ে আসলো, আর ওই মেয়ের কষ্টের কথা শুনে সে নিজের একটা জামা দিয়ে দিলো।
—রাতে খেতে বসে জিজ্ঞেস করলাম,
~আমার তো অফিস থেকে ফিরতে প্রায় দেরি হয়। তুমি তো আগেই খেয়ে নিতে পারো। শুধু শুধু একসাথে খাওয়ার জন্য কেনো অপেক্ষা করো।
-কে বলেছে আপনার জন্য অপেক্ষা করি। আপনি আসার আগেই আমি এক তরকারি দিয়ে খেয়ে নেই, পড়ে আপনি আসলে শুধু ডাল দিয়ে খাই।
~সব সময় সব প্রশ্নের উত্তর জানা থাকে তোমার, তাই না?
-হুম, যেমনভাবে আপনার সব উত্তরের প্রশ্ন জানা থাকে।
—বই পড়ছিলাম, সে পাশে থেকে বলে উঠলো,
-আকাশের মেঘ ধরবেন?
~আকাশের মেঘ আবার কিভাবে ধরে!
-চট্রগ্রামের একটা পাহাড়ের চূড়ায় দাড়িয়ে আকাশের মেঘ ধরা যায়।
~বাহ্, ডায়েরি লিখে লিখে ভালই সাহিত্যিক হয়ে উঠেছো। বই একটা লিখে ফেলো।
-হুম, লিখবো তো, ভ্রমণ কাহিনী!
~তা ভ্রমণের ইচ্ছেটা কবে শুনি।
-আপনার ছুটি হলেই না যাবো।
~দেখি দরখাস্ত করে, আগামী মাসে ছুটি পাওয়া যায় কিনা।
—আজকে কিছু আত্মীয় বেড়াতে এসেছিল। ছোট একটা ভুলের জন্য এক আত্মীয়া ওকে খুব বকা দিচ্ছিল। মনে করেছিলাম মেহমান চলে যাওয়ার পর আমার কাছে কেঁদে কেঁদে বিচার দিবে। আশ্চর্য হলাম, যখন দেখলাম এই বিষয়ে সে কোনো কথাই বলছে না। নিজে থেকেই বললাম,
~আজকে তোমাকে অনেক কথা শুনতে হলো।
-আরে! আপনি আবার এই বিষয়ে কথা তুলছেন কেনো? উনারা তো রোজ রোজ আসে না বাসায়। আজ বেড়াতে এসে একটু কথা শুনিয়েছি আর কি। এই এক দিনের জন্যই যদি আপনার কাছে নালিশ দেই, বিষয়টা কেমন না।
~বাহ্, তোমার ভালই ধৈর্য্য আছে দেখছি।
-ধৈর্য্য না কচু, কেউ আমাকে কথা শোনাতে আসলে ঠাস করে মুখের উপর কিছু বলে দেই। আজকে অনেক কষ্টে নিজেকে আটকে রেখেছিলাম।
—রমজানের শেষের দশদিন এতেকাফে বসেছিলাম। সে প্রতিদিন রাতের খাবারের সাথে একটা করে চিঠি পাঠাতো। চিঠির কথাগুলো নাইবা লিখলাম। দশদিন শেষে দশটা চিঠি সঙ্গে নিয়ে বাড়িতে এসে ওকে জিজ্ঞেস করলাম,
~লেখাগুলো মোবাইলে মেসেজ করাও তো যেতো, চিঠি পাঠালেন যে?
-গল্প কি শুধু আপনিই পড়েন, আমি পড়ি না। আগের দিনের স্বামী স্ত্রীরা একে অপরকে এভাবেই চিঠি লিখতো। চিঠিগুলো যত্ন করে রেখে দেন, আমি কোথাও চলে গেলে এইগুলো পড়ে পড়ে সান্তনা পাবেন।
—বিয়ের পর থেকে সে ইসলামের বিধানগুলো তেমন পালন করতো না। কিন্তু এখন তার জীবনে ইসলামের সৌন্দর্য ফুটে উঠেছে। ঐদিন আমি যখন মাইগ্রেনের ব্যাথায় বিছানায় পড়ে ছিলাম, সে মাঝ রাতে উঠে নামায পড়ে আমার সুস্থ্যতার জন্য আল্লাহর দরবারে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছিল।
—আমার কাছে ওর ছোটোখাটো বিষয়গুলো অনেক ভালো লাগে। প্রতিদিন সকালে অফিসে যাওয়ার সময় সোফায় বসিয়ে আয়াতুল কুরসী পড়ে ফু দিয়ে দেয়। কাপড় চোপড় ময়লা করে রাখলে হালকা বোকা দেয়। আর যখন বিস্কুট খেয়ে ভুলে কৌটোর মুখ খুলে আসি, তখন সে আমার সামনে এসে চোখ দুটো বড় বড় করে তাকিয়ে কৌটোর মুখ লাগাতে থাকে।
—ঐদিন আবিষ্কার করলাম সে সুরেলা কণ্ঠে ইসলামী সঙ্গীত গাইছে। জিজ্ঞেস করলাম,
~তুমি এত সুন্দর গজল গাইতে পারো, আমাকে বলোনি কেন?
-আপনি জিজ্ঞেস করেননি,তাই বলি নি।
~এখন থেকে প্রতি রাতে একটা করে গজল শুনাতে হবে আমাকে।
-মাসে এক হাজার টাকা দিতে হবে।
~ত্রিশ দিন গজল শুনাবে, মাত্র এক হাজার টাকা নিলে কি হবে, একটু বাড়িয়ে নেও!
-না, আপনাকে স্বামী হিসেবে কিছু ডিসকাউন্ট দিলাম!
দুষ্টুমি করে বললাম,
~তাহলে এক কাজ করি তোমার গজল রেকর্ড করে ইউটিউবে দিয়ে দেই, মাস শেষে ভালো টাকাও আসবে আর তুমি বিখ্যাত হয়ে যাবে।
-বিখ্যাত হয়ে লাভ কি, দেখেননি বলিউড অভিনেত্রী জায়রা ওয়াসিম বিখ্যাত হয়ে আবার দ্বীনের পথে ফিরে এসেছে।
—অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিলাম। সে আমার জন্য নাস্তা বানাচ্ছিল। হঠাৎ কি যেনো হলো আর সে অজ্ঞান হয়ে ফ্লোরে পড়ে গেলো। আমি তাড়াতাড়ি কোলে তুলে বিছানায় নিয়ে আসলাম। কিছুক্ষণ পর জ্ঞান ফিরলে জিজ্ঞেস করলাম,
~কি হয়েছিলো?
-ফযরের পর থেকে মাথাটা ঘুড়ছে।নাস্তা বানাতে গিয়ে হঠাৎ করে পুরো শরীর অবশ হয়ে পড়ে গেলাম।
~ফযরের পর থেকে মাথা ঘুড়ানি নিয়ে বসে ছিলে কেন। নাস্তার কথা না ভেবে আজ তো ঘুমিয়ে যেতে পারতে। এক দিন বাইরে থেকে নাস্তা খেয়ে অফিসে গেলে কি এমন হতো।
—আজ সন্ধ্যায় ওর সাথে বসে চা খাচ্ছিলাম। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে কি যেনো ভেবে বলে উঠলাম,
~এই যে মাসের পর মাস চলে যাচ্ছে, আমি তো তেমন কোনো উপহারই তোমাকে দিতে পারলাম না। আর তুমিও তো নিজের থেকে কিছু চাও না।
-আপনি দেন না দেখে, আমিও চাই না।
~মানে।
-আসলে যেসব স্বামীরা তাদের স্ত্রীদের বেশি বেশি উপহার দেয়, সেসব স্বামীদের কাছ থেকে স্ত্রীদের আশা-আকাংক্ষা বেশি হয়। আপনি দেন না, তাই আমার চাহিদাও নাই।
কথাটা কেমন জানি আমার মনে আঘাত করলো।
সে হেসে হেসে বললো,
-আরে, আপনি দেখি কথাটা সিরিয়াসভাবে নিয়ে নিয়েছেন। আমি তো মজা করেই না বললাম। আসলে দেখেন, আপনার বেতন তো এখন কম, তাই বেশি কিছু চাই না। আস্তে আস্তে যখন আপনার বেতন বাড়বে তখন নাহয় আমার জমানো চাহিদাগুলো আপনাকে জানাবো।
—বারান্দায় এসে দেখি সে নীরবে কাঁদছে। জিজ্ঞেস করলাম,
~কি ব্যাপার, কাঁদছেন কেনো?
-মায়ের জন্য।
~তাই বলে এভাবে কাঁদতে হবে। এবার ঈদেই তো আমরা তোমাদের বাড়ি যাচ্ছি, তখন তো মায়ের সাথে দেখা হবেই।
-আরে আমি সে জন্য কাঁদছিনা। নিজের ভুলের জন্য কান্না আসছে। এখন যখন নিজের সংসারের কাজকর্ম করছি, মায়ের কষ্টগুলো একে একে চোখের সামনে ভেসে উঠছে। বিয়ের আগে মা আমাদের নিয়ে কত চিন্তা করতেন। পরিবারটাকে আগলে রাখার জন্য কত কি করতেন। কিন্তু তখন কিছুই খেয়াল করতাম না। হেসে খেলে জীবনটা কাটিয়ে দিতাম, একটু ঊনিশ-বিশ হলেই মাকে কথা শুনিয়ে দিতাম। এখন খুব খারাপ লাগে সেগুলো ভেবে। ইচ্ছে হয় দিনগুলো ফিরে পেতে। মাকে কাজে সাহায্য করতে মন চায়, মায়ের সাথে থেকে থেকে উনার টেনশনগুলো ভাগাভাগি করে নিতে ইচ্ছে হয়।
—অফিস থেকে বাসায় এসে ফেইসবুক চালাচ্ছিলাম। সে এসে ফোনটা এক প্রকার ছিনিয়ে নিল।বলল,
-কি করেন এত ফেইসবুকে। সারাদিন কোন মেয়ের সাথে চ্যাটিং করেন। আপনি চাইলে আমিও কোনো ছেলেকে ফাঁসিয়ে চ্যাটিং শুরু করে দেই।
~তুমি চাইলেই অনেক ছেলেকে ফাঁসিয়ে চ্যাটিং করতে পারবে। কিন্তু ফেইসবুকে আমাকে কোন মেয়ে পাত্তা দিবে শুনি। কথাই বলতে পারি না ঠিকমত, আবার মেয়ে পটাবো!
-বুঝি বুঝি সবই বুঝি, আপনার মত এইরকম হাবাগোবা সেজে থাকা লোকগুলোই বেশি মেয়ে পটাতে পারে।
—সারাদিনের সংসারের কাজ শেষে ক্লান্ত শরীরে সে পাশে এসে শুয়ে পড়লো। ওর পরিশ্রান্ত মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
~বিয়ের আগে তো ইচ্ছেমত চলতে পারতে। বিয়ের পরে এখন তো তোমাকে ধৈর্য্য ধরে সংসার করতে হচ্ছে।
-ধৈর্য্য কি সবসময় থাকে নাকি। যখন মনের মাঝে অস্থিরতা লাগে তখন প্রিয় মানুষগুলো থেকে মোটিভেট হই।
~প্রিয় মানুষের থেকে মোটিভেট!
-হুম, আমার প্রিয় মানুষ বিবি আছিয়া(আ:), মরিয়ম(আ:), ফাতেমা (রা:)। উনাদের জীবনী যখন পড়ি তখন মনের মাঝে ধৈর্য্য চলে আসে।
—খুব সকালে আজ সমুদ্রের পাড়ে বেড়াতে এসেছি। এই সময়টায় মানুষ খুব কম থাকে। দুজনে হাত ধরে হাঁটছিলাম, সে বলে উঠলো,
-আপনি এত বেরসিক কেন! দেখছেন আশে পাশে কেউ নেই। কোথায় আমাকে ধাক্কা দিয়ে পানিতে ফেলে দিবেন, আমার গায়ে পানির ছিটা দিবেন, তা না গম্ভীর হয়ে হাঁটছেন।
আমি ঠাস করে ওকে ধাক্কা দিয়ে পানিতে ফেলে দিলাম।
-করলেনটা কি! আমি বললাম আর আপনি আমাকে ধাক্কা দিয়ে দিলেন। বুদ্ধি সুদ্ধি কবে হবে আপনার।
ডায়রীটা পড়া অবস্থায় আম্মু ডাক দিলো দুপুরের খাওয়ার জন্য। খেতে বসেছি আর বড় বোন বলে উঠলো,
-তুই নাকি ডায়েরি ওয়ালা লোকটার প্রেমে পড়েছিস।
~কি বলো এইসব। আমাকে কি তোমার ঐরকম ছেলে মনে হয় নাকি!
-শোন, ছেলেদের উচিত সমাজের সৎ মানুষগুলোর আদর্শে প্রেমে পড়া। সেই আদর্শ নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করা।
~হইছে হইছে আর জ্ঞান দিতে হবে না। নিজে তো ঠিকমত চলো না, আবার আমাকে আসছো জ্ঞান দিতে।
খাবার শেষে রুমে এসে ডায়রীটা হতে নিলাম বাকিটুকু পড়ার জন্য। তখনি মাথায় আরেকটা অদ্ভুত বুদ্ধি এসে হাজির হলো। নিজেকে নিজে বাহবা দিয়ে মনে মনে বলে উঠলাম,
-এতো বুদ্ধি আসে কিভাবে মাথায়।
চট করে ফোনটা হাতে নিয়ে কল করলাম বুদ্ধিমান হাবাগোবা মানুষটাকে।

Be the first to write a review

Leave a Reply

We’re sorry you’ve had a bad experience. Before you post your review, feel free to contact us, so we can help resolve your issue.

Post Review

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সাম্প্রতিক গল্প