দুুটি মানুষের ভালোবাসার সম্পর্কের সবচেয়ে বড় খুঁটি হল বিশ্বাস। এই খুঁটি যেমন মজবুত হয় তেমনই নাজুক হয়। সম্পর্কের বাকি খুঁটি যেমন রাগ অভিমান সহজের দূর করা যায়। কিন্তু বিশ্বাস, বিশ্বাস একবার ভেঙে গেলে তা দ্বিতীয় বার আর গড়ে না বা গড়া যায় না।
একজন বিশ্বাসঘাতকতা করলে অপরজনকে সেই সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসা অতি আবশ্যক। পুরো জীবনে কষ্ট বয়ে বেড়ানোর থেকে একেবারে ঝেড়ে ফেলা ভালো।
রিসাদ আর রিয়া বিয়ে করে বেশ সুখে আছে। সেদিন কোর্ট থেকে বের হবার পর দীপ্তির সাথে রিসাদের আর দেখা হয় নি। রিসাদ দূর থেকে দীপ্তির উপর নজর রেখেছে। কখন কি করছে, কোথায় যাচ্ছে সবটা রিসাদ জানে। ঘরের বাইরে বেরলে দুটো লোক দীপ্তির পিছু নেয়।
রিসাদ মনে করে দীপ্তি কিছু জানে না। কিন্তু দীপ্তি সবটা জানে।
কিছু মানুষকে প্রথম দেখাতেই চেনা যায় সে কেমন, আর কিছু মানুষকে বছরের পর বছর দেখেও চেনা যায় না।
এখানে রিসাদের অবস্থাও তাই হয়েছে। ও চিনতে পারে নি দীপ্তিকে। দীপ্তি প্রখর বুদ্ধির অধিকারী। ওর সিক্স সেন্স প্রখর। যা রিসাদ এতো দিনেও বুঝতে পারে নি। রিসাদের ভাবনা যেখান থেকে শেষ হয় দীপ্তির ভাবনা সেখান থেকে শুরু হয়।
কিন্তু দিন যত গড়াচ্ছে দীপ্তির শরীর তত খারাপ হচ্ছে আর ভয় বাড়ছে। রীতা সিদ্ধান্ত নিয়েছে দীপ্তিকে দূরে কোথাও পাঠাবে। কিন্তু দীপ্তি নারাজ, সে কোথাও যাবে না।
ওটিতে আছে দীপ্তি, বাইরে অপেক্ষা করছে রীতা, আর দীপ্তির মা-বাবা, দূরে দাড়িয়ে আছে রিসাদ।
ডেলিভারির পরে বাচ্চাটাকে দীপ্তির থেকে আলাদা করে নিয়ে যাওয়ার জন্য দাড়িয়ে আছে রিসাদ, বলতে গেলে বাচ্চাটা চুরি করবে রিসাদ।
কথায় আছে না, চোরের দশ দিন গিরস্থর একদিন।।
ওটি থেকে খবর আসে দীপ্তি মরা বাচ্চা জন্ম দিয়েছে। দূর থেকে এ খবর শুনে রিসাদ বসে পরে। যতই ও দীপ্তির থেকে বাচ্চাকে কেঁড়ে নেয়ার কথা বলুক কিন্তু কখন বাচ্চার ক্ষতি চায় নি। দীপ্তির কাছে হারতে পারবে না বলে বাচ্চা চুরির কথা ভাবে। বাচ্চাটা নিয়ে রিসাদ অনেক পরিকল্পনা করে, কিভাবে বড় করবে? কিভাবে রাখবে?ইত্যাদি ইত্যাদি। অনেক স্বপ্ন দেখে ও। নার্সের কথা শুনে সব স্বপ্ন কাঁচের মতো ভেঙে যায়। রিসাদ চোখের পানি মুছে দ্রুত বাইরে বেরিয়ে আসে।
৫ দিন পর হসপিটাল থেকে ছাড়া হয় দীপ্তি আর ওর বাচ্চাকে। হ্যাঁ দীপ্তি জীবিত বাচ্চা জন্ম দিয়েছে। রিসাদ বাচ্চা চুরি করতে পারে, এমনটাই আঁচ করে দীপ্তি ডাক্তারদের আগে থেকে বলে রেখেছিল বাচ্চার আসল খবর যেন বাইরে বলা না হয়।
বাচ্চা মুখ দেখে কান্না করে দীপ্তি। পুরো রিসাদের কার্বন কপি। এমন অবস্থায় শুধু রিসাদের কথা মনে পরে দীপ্তির। কত কি ভেবেছিল দুজনে।
‘রিসাদ আমি মা হতে চাই।’
দীপ্তি মুখে এ কথা মুনে খুব খুশি হয় রিসাদ। রিসাদও একটা বাচ্চার কথা ভাবছিল কিন্তু তা আর বলা হয় নি।
‘আচ্ছা দীপ্তি তোমার ছেলে বাবু চাই নাকি মেয়ে বাবু?’
‘ছেলে বাবু চাই, ঠিক তোমার মতো।’
‘আমার মেয়ে বাবু চাই তোমার মতো।’
পুরনো কথা মনে পরতেই চোখের পানি বাঁধ ভাঙে।
সব কিছু পাল্টে গেছে। একটা ঝড় দীপ্তির জীবনের সব সুখ কেঁড়ে নিয়েছে।
দীপ্তি সবাইকে জানায় ও এখান থেকে চলে যাবে। বাচ্চাকে নিয়ে রিসাদের নাগালের মধ্যে থাকতে পারবে না। দীপ্তির সিদ্ধান্তে সবাই সায় দেয় আর ওকে শহরের বাইরে দূরে কোথাও পাঠিয়ে দেয়।
সময় নিজের মতো বয়ে যাচ্ছে। সবাই নিজের মতো নিজের জীবন গুছিয়ে নিচ্ছে। রিসাদ বুঝতে পেরেছে, ও হিরা ছেড়ে কাচের পিছনে ছুটছে। জীবনে সবচেয়ে বড় ভুল করেছে দীপ্তিকে নিজের থেকে আলাদা করে। দীপ্তির কাছ থেকে ক্ষমা চাওয়ার জন্য ওকে তন্নতন্ন করে খুঁজছে রিসাদ।
দীপ্তি নিজের নতুন চাকরি, মেয়ে দৃষ্টি আর নতুন সংসার নিয়ে ভালো আছে সুখে আছে। কিন্তু মাঝে মাঝে রিসাদের অনুপস্থিতি অনুভব করে। রিসাদ যদি ডিভোর্সের আগে ওর কথা গুলো একবার শুনত তাহলে কতই না ভালো হতো।
আসলে সুখ এমনই একটা জিনিস যা অনেকে শত কষ্ট করেও পায় না, আবার অনেকে বিনা কষ্টে সুখ পেয়েও তার মর্ম বুঝে না।
বছর গড়াচ্ছে। দৃষ্টি বড় হচ্ছে, দীপ্তির চুলে পাক ধরছে,শরীরের শক্তি কমে গেছে । দীপ্তি দৃষ্টিকে একসাথে দেখে মা-মেয়ে মনে হয়না, মনে হয় বান্ধুবী। দীপ্তি নিজের সবটা দিয়ে বড় করছে,ভালো রাখছে দৃষ্টিকে। দীপ্তি দৃষ্টির থেকে ওর বাবার কথা আড়াল করে নি। যখন যা জানতে চেয়েছে তখন যতটা বলা যায় তাই বলেছে। দৃষ্টি জানে ওর বাবা-মা কেন আলাদা হয়েছে, আর এটাও জানে ওকে নেয়ার জন্য কি কি করেছে। দৃষ্টি এতটা জেনেও ওর বাবার উপর রাগ করতে পারে না। কারণটা হল দীপ্তি, দীপ্তি রিসাদকে এখন ততটা ভালোবাসে যতটা আগে ভালোবাসত।
একদিন দৃষ্টি ওর মা দীপ্তিকে প্রশ্ন করে,
‘আচ্ছা মা, বাবা যদি কোনোদিন তোমার কাছে এসে ক্ষমা চায় আর বলে নতুন করে সবটা শুরু করতে, তখন তুমি কি বলবে?’
দীপ্তি মেয়ের কথা শুনে অবাক। দীপ্তি নিজেও এমনটা বহুবার ভেবেছিল, পরে অবশ্য সেসব ভাবনা বাদ দিয়েছিল।
‘এমনটা কোনোদিন হবে না রে, তাই এসব ভাবনা না ভাবাই ভালো। ‘
‘আহ্ মা বল না, প্লিজ।’
‘দৃষ্টি তোর বাবা আমাকে ভুলে গেছে আর আমিও তাকে ভুলে গেছি। তাছাড়া তার নিজের স্ত্রী সন্তান আছে। ও তো জানেই না তুই পৃথিবীতে আছিস।’
‘তোমার চোখের পানি কিন্তু বলছে তুমি বাবাকে ভুলনি এবং তুমি বাবাকে খুব ভালোবাস।’
‘দুষ্টু মেয়ে মায়ের সাথে ফাজলামি হচ্ছে, কান টেনে দিব কিন্তু। ‘
‘মা তোমার যা ইচ্ছে তাই কর কিন্তু প্লিজ আমার প্রশ্নের উত্তর দাও।’
‘দৃষ্টি আমি কিন্তু রেগে যাচ্ছি। ‘
‘ওকে ওকে বলতে হবে না। তাও তুমি রাগ কর না, রাগলে তোমাকে একটুও ভালো লাগে না। গাল দুটো, নাকের মাথা কেমন যেন লাল লাল হয়ে যায়, দেখতে পুরো পেত্নীর মতো লাগে আর চোখ দুটো মনে হয় ভিতরে ঢুকে যাবে, তখন সবাই তোমাকে কানি বলবে। এ সব কি আর আমার শুনতে ভালো লাগে বল।’
‘আজ তোর হচ্ছে, দাড়া তুই।’
দীপ্তিকে উঠতে দেখে দৃষ্টি দৌড় লাগায়।
দীপ্তি আবার বসে পরে,
‘তুই একদম তোর বাবার মতো হয়েছিস রে। তোর বাবাও বলত রাগলে আমাকে পেত্নীর মতো লাগে। তোর পছন্দ অপছন্দ অনেকটাই তোর বাবার মতো। আজ তোর বাবা আমাদের সাথে থাকলে খুব খুশি হত রে। কিন্তু আফসোস! সে পথভ্রষ্ট হয়ে আমাদের থেকে দূরে। ‘
পর্দার আড়ালে দাড়িয়ে মায়ের সব কথা শুনেছে দৃষ্টি।
‘তুমি বাবার উপর রেগে আছ জানি কিন্তু আজও বাবাকে ভালোবাস।
ভালোবাসার মানুষের উপর যতই রাগ বা অভিমান থাকুক না কেন, দিন শেষে তুমি তাকে ক্ষমা করে দেবেই।’
‘দৃষ্টি তোমার মা তোমাকে খুব ভালোবাসে, তাইনা?’
‘হ্যাঁ আঙ্কেল মা আমাকে খুব ভালোবাসে আর বাবাকেও।’
‘তোমার বাবা কি করে?’
‘জানি না।’
‘মানে?’
‘আমার জন্মের আগে বাবা অার মায়ের ডিভোর্স হয়ে গেছে।’
‘জানি না আমার মতো ভুল আর কতজন করেছে আর করবে।’
‘কি ভুল করেছ তুমি?
‘আমি অনেক বড় ভুল করেছি, যার কোনো ক্ষমা হয় না। নিজের সবচেয়ে কাছের সবচেয়ে প্রিয় মানুষটিকে নিজের থেকে আলাদা করে দিয়েছি। জানি না সে কোথায় আছে, কেমন আছে?
আজও আমি তাকে খুঁজছি, তার কাছে ক্ষমা চাওয়ার জন্য। তার কাছে ক্ষমা না পেলে যে মরেও শান্তি পাব না।’
শেষের কথা শুনে দৃষ্টির চোখ ভিজে যায়। আড়ালে চোখ মুছে আর বিরবির করে বলে
‘ভাগ্য যাদের এক করতে চায়, তাদের আলাদ করার সাধ্য কারোর নেই।’