আমাকে ঘিরে পি’শাচের মতো দেখতে মানুষগুলো দাঁড়িয়ে আছে সবাই। নারকীয় এক নিস্তব্ধতা সারা ঘর জুড়ে। সবার দৃষ্টি একরকম। সেই চাহনিতে না আছে কোনো রাগ না আছে কোনো ভালোবাসা। কিন্তু তবুও সেই নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে এমন কিছু আছে আমি তাকাতে পারলাম না সেদিকে। আমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছি। আমার চারপাশে টিমটিমে আলোয় জ্বলছে মোমবাতি গুলো। আর যে মেয়েটার সাথে খারাপ কিছু হতে যাচ্ছিলো তাকে ফেলে রাখা হয়েছে একপাশে একটা শক্ত রশি দিয়ে বেঁধে। ডুবন্ত মানুষ বেঁচে থাকার জন্য যেমন খড়কুটো আঁকড়ে ধরতে চায়, মেয়েটিও বোধহয় তাই। হয়তো আমাকে অনেক ভরসার কেউ ভাবছে। কিন্তু আমিও যে তার মতো জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি তা আমি বেশ ভালো করে বুঝতে পারছি।
যে লোকটা আমাকে ধরে এখানে এনেছে সে মনে হয় এই দলের লিডার টাইপ কিছু। গলা শুনে মনে হয়েছিলো মনে হয় বিশাল দেহের কুস্তিগীর ধরনের চেহারা হবে। কিন্তু অবাক ব্যাপার! অত্যন্ত বয়স্ক একজন লোক। কালো একটা সেলাইবিহীন কাপড় দিয়ে কোনোরকমে শরীরটা ঢেকেছে। বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছে শরীর। একটা লাঠিতে ভর করে দাঁড়িয়ে আছে।
“আবু তোমার উপর ভরসা করে কি তবে ভুল করেছি আমি?”
নীরবতা ভাঙলো লোকটা। সেই বাজখাঁই গলা। আমি চমকে উঠলাম। এমন প্রবীণ একজন মানুষ তার এমন কণ্ঠ কীভাবে হয়?
আমতা আমতা করে আবু মিয়া বললো,”জনাব আমি কি করবো? মফস্বলে এমন একটা পরিত্যক্ত বাড়ি আর কোথায় পাবেন আপনি? এখন অফিস থেকে যদি নির্দেশনা আসে এখানে মানুষ থাকবে আমি কি করতে পারি?”
আমি চোখ লাল করে তাকালাম আবু মিয়ার দিকে। তার মানে অফিস কোয়ার্টারটাকে পরিত্যক্ত বানিয়ে এরা এভাবে ব্যবহার করছে?কিন্তু কি করে এরা এই বাড়ির মধ্যে?
আবু মিয়া গাল চুলকাতে চুলকাতে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,”আম্মাজান, বেশি কৌতুহল থাকা কিন্তু ভালো না, বুঝছেন? আপনি বেশি কৌতুহল দেখিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু আপনি বোধহয় জানেন না এই ঘরটা মৃ*ত্যুকূপ। এই দলের সদস্য ব্যতীত যারা এই ঘরে ঢোকে তাদেরই মৃ*ত্যুবরণ করতে হয়।”
আমার হৃৎপিণ্ড গলার কাছে এসে যেনো ধকধক করা শুরু করলো। আমাকে এরা মেরেই ফেলবে? আমি আমার মায়ের কাছে কোনোদিন যেতে পারবো না আর? কেউ তো জানতেও পারবে না আমি এখানেই শেষ হয়ে গিয়েছি।
“মা মা মানে? আপনারা কি করেন এখানে? এরাই বা কারা আবু চাচা?”
এখানে আসার পর এই প্রথম আমি একটা কথা বললাম। আমি খুব শক্ত ধাঁচের মেয়ে। এতো সহজে আমি হার মানবো না। মরলে এদের কয়েকটাকে নিয়েই মরবো।
আমার কথা শুনে সবাই চোখ গোল গোল করে আমার দিকে তাকালো। যেখানে আমার ভয়ে তাদের পায়ে পড়ে যাওয়া উচিত সেখানে আমি জোর গলায় কথা বলছি এটা যেনো কেউ মানতেই পারছে না।
আবু মিয়া দাঁতে দাঁত চেপে বললো,”আপনার সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবেন খুব তাড়াতাড়ি। আপনাদের কোনো ক্ষতি করতে আমি চাইনি। কিন্তু নিজেই যখন নিজের পায়ে কুড়াল মারলেন এখন আর কিচ্ছু করার নেই আমার।”
“আবু তুমি কি বুঝতে পারছো কতোবড় একটা সর্বনাশ হয়ে গেলো আমাদের? বুঝতে পারছো তুমি? ঠিক তিনটার সময় কুমারী নারীকে যেখানে তার উদ্দেশ্যে বলি দেওয়ার কথা, সেখানে এতো বড় একটা বাঁধা এলো। কি হবে এর পরিণাম জানো তুমি? আমাদের কাউকে ছেড়ে দিবে না, কাউকে না।”
বৃদ্ধ লোকটা এটা বলেই খকখক করে বিশ্রী আওয়াজে কাশতে শুরু করে দিলো। আমি যেনো অবাক হওয়ার মাত্রাও ছাড়িয়ে ফেলেছি। কুমারী মেয়েকে বলি? মানে এই মেয়েটাকে কারো উদ্দেশ্যে বলি দিতে চেয়েছিলো এরা? কার উদ্দেশ্যে?
আমি বিস্ফারিত চোখে তাকালাম আবু মিয়ার দিকে। তোতলাতে তোতলাতে বললাম,”কি হচ্ছে কি আবু চাচা? বলি দিবেন মানে? একটা জলজ্যান্ত মানুষকে আপনারা বলি দিবেন? আপনারা কি মানুষ?”
আমার কথা শুনে সবাই খুব অদ্ভুত ভাবে তাকালো আমার দিকে। প্রায় মিনিট দুই সবাই চুপ করে থাকলো। হঠাৎ সবাই একসাথে শব্দ করে হাসতে শুরু করলো। কি সেই হাসির শব্দ! অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে। একেই বুঝি বলে পৈশাচিক হাসি। মেয়েটার দিকে তাকিয়ে দেখলাম সেও আমার দিকে তাকিয়ে আছে অদ্ভুতভাবে। ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো শুধু।
হাসি কোনোরকমে থামিয়ে ওদের মধ্যে থাকা একটা মহিলা বললো,”তা মেয়ে তোমার ধারণা আমরা মানুষ?”
আমি ভয়াবহভাবে চমকে উঠে তাকালাম ওই মহিলার দিকে। মানুষ না মানে? দিব্যি দেখছি মানুষের মতো চেহারা, নিশ্চয়ই আমাকে ভয় দেওয়ার চেষ্টা করছে।
বৃদ্ধ লোকটা দাসী শ্রেণির এক মহিলাকে বললো,”যাও ভিতর থেকে আমার জন্য এক পেয়ালা র*ক্তরস পানীয় আনো। গলা ভিজিয়ে নিই আগে। অনেক বড় বিপদ আসতে চলেছে। এর আগে মাথা ঠান্ডা করতে হবে।”
মহিলা চলে গেলো ভিতরে। আমার গা গুলিয়ে বমি আসলো, র ক্তরস পানীয় আবার কি?
আবু চাচা বৃদ্ধের কাছে এসে বললো,”এখন কি হবে জনাব? তিনি কি আমাদের উপর রেগে যাবেন? আমাদের মেরে ফেলবেন?”
বৃদ্ধ কিছু বললো না। চুপ করে অন্যদিকে তাকিয়ে জোরে জোরে নিঃশ্বাস ছাড়তে লাগলো। মহিলা ভিতর থেকে একটা পেয়ালায় খুব বিদঘুটে রঙের একটা পানীয় এনে দিলো। কি বিশ্রী একটা গন্ধ আসতে থাকলো ওটা দিয়ে। আমি আর ধরে রাখতে পারলাম না। ওখানে দাঁড়িয়েই হরহর করে বমি করে দিলাম। ওদের দলের সবাই কিছু বললো না। ভ্রু কুঁচকে তাকালো শুধু।
বৃদ্ধ পাত্রে একটা চুমুক দিয়ে বললো,”বিড়ালগুলো শুটকো ধরণের ছিলো। র ক্ত মজা না। আগের বারের টা বেশ মজার ছিলো আবু।”
আমার নিঃশ্বাসে কষ্ট হতে থাকলো। এ কি পিশাচের ডেরায় এসে পড়লাম আমি। কেনো নিজে থেকেই নিজের জীবন বিপন্ন করে দিলাম এই ভয়াবহ মানুষগুলোর মাঝে। আচ্ছা, আদৌ এরা মানুষ তো?
পেয়ালার পুরোটা পানীয় বৃদ্ধ শেষ করার পর বাকিদের দিকে তাকিয়ে বললো,”শোনো সবাই আমার কথা। তিনি আমাদের উপর ভীষণ রুষ্ট হয়েছেন। তিনি চাইলে আমাদের ধ্বংসও করে দিতে পারেন। আমরা যা চাই তাতো পাবোই না উলটে আমরা শেষ হয়ে যাবো। আর সব হয়েছে এই মেয়েটার জন্য।”
বলেই সে আমার দিকে তাকালো ভয়ংকর দৃষ্টিতে।
আবু মিয়া এবার বৃদ্ধের পায়ের কাছে বসে বললো,”তবে এখন কি করবো জনাব? আপনি বলে দিন এর থেকে পরিত্রাণের উপায়। আমার ভুল হয়ে গেছে।”
“একটা উপায় আছে। তাকে দ্বিগুণ খুশি করতে হবে।”
সবাই একসাথে বলে উঠলো,”কীভাবে জনাব? কীভাবে?”
“ওই মেয়েটার সাথে এই মেয়েটাকেও আমরা বলি দিবো তার উদ্দেশ্যে।”
আমার বুক কেঁপে উঠলো। কীভাবে বাঁচাবো নিজেকে এখন?
বাকি সবাই খুশিতে হাততালি দিয়ে উঠলো। আমি হতভম্ব হয়ে তাকালাম আবু মিয়ার দিকে। সে তো আমাকে বাঁচাতে পারে। কিন্তু না, সবার সাথে সেও হাততালি দিচ্ছে।
আমি চিৎকার করে বললাম,”আমার বাবা কে চিনো না তোমরা। পুলিশে ধরিয়ে দিবে তোমাদের। কেউ বাঁচতে পারবা না।”
সবাই আমার কথা শুনে হো হো করে হাসতে থাকে। চোখে পানি চলে আসে সবার হাসতে হাসতে।
আবু মিয়া বললো,”তাই নাকি? তা তোমাদের মানুষ পুলিশ আমাদের জেলে ঢুকাবে? কিন্তু আমরা তো মানুষ নই।”
“আপনারা তবে কি?”
এরপর আমি শুনলাম এমন কিছু কথা, যা নিজের কানে না শুনলে কোনোদিন বিশ্বাস করতে পারতাম না।
“আমরা হলাম রাঘানিয়া। এক শ্রেণির নেকড়ে আমরা। আমরা নিজেদের প্রয়োজনে মানুষের রূপ নিতে পারি। আর যার উপাসনা করি আমরা তিনিই আমাদের সেই শক্তি দিয়েছেন। আমরা তাকে সর্বোচ্চ খুশি করতে পারলে এই পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি শক্তিধর হবো আমরা। তাই আমরা তাকে খুশি করার জন্য এই মেয়েটাকে বলি দিতে এনেছি। কিন্তু তুমি মাঝে এসে সব নষ্ট করে দিয়েছো। তাই এখন তোমাকেও মরতে হবে সাথে। বলি হতে হবে তার উদ্দেশ্যে।”
আমি কাঁপতে কাঁপতে বললাম,”কে সে? কার উদ্দেশ্যে? ”
আবু মিয়া কিছু বলতে যাবে তার আগেই হঠাৎ করে দমকা হাওয়ায় সবগুলো মোমবাতি নিভে গেলো। কেউ একজন শক্ত করে আমার হাত চেপে ধরলো। আমি হাত ছুটাতে চেষ্টা করলাম, কোনোভাবেই পারলাম না। তীব্র একটা গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে গেলো। ধুপধাপ করে শব্দ হতে থাকলো যেনো কেউ দৌড়াচ্ছে ঘরের মধ্যে। আচমকা একটা কণ্ঠ শুনলাম,”সে আসছে।”
কে আসছে?